প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার পথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এর বড় কারণ সমকালে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায়নি। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় রাজ পৃষ্ঠপোষকতায় দরবারী ইতিহাসও লেখা হয়নি। ফলে সাহিত্যের সূত্র, পর্যটকদের বিবরণ এবং সামান্য প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ব্যবহার করে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখা আধুনিক কালের একটি প্রয়াস বলা যেতে পারে। মধ্যযুগের ইতিহাস লেখায় বাড়তি সুযোগ এসেছে দিল্লিতে বসে সুলতান ও মোগল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখা দরবারী ইতিহাস। এসব সূত্র ব্যবহার করে লেখা ইতিহাস রাজনৈতিক ইতিহাসের গণ্ডি পেরুতে পারেনি অনেক কাল পর্যন্ত। সেই অর্থে সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস লেখা একেবারে সাম্প্রতিক কালের প্রয়াস। এমন বাস্তবতার আদি সময়ে অনেকটা শূন্যতার মধ্য দিয়েই রমেশচন্দ্র মজুমদারকে ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’ নামে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস লেখার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। গত শতকের চল্লিশের দশকে রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন বাংলা ভাষায় বাংলার ইতিহাস লেখার পরিকল্পনা করেন তার অনেক বছর আগে অনেকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে লেখা দুটো মাত্র গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এর একটি গৌড়রাজমালা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাম প্রসাদ চন্দের এই বইটি বাংলা ১৩৩৯ সাল অর্থাৎ ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এটি পূর্ণাঙ্গ কোনো বাংলার ইতিহাস নয়। তবু বাংলার ইতিহাস রচনার পথে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ বলা যায়। এর দুই বছর পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষায় রচনা করেন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’। এরপর দীর্ঘ বিরতি কাটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই খণ্ডে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস লেখার প্রকল্প গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত হয় গ্রন্থ দুটো হবে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের প্রবন্ধের সংকলন। প্রাচীন যুগের গ্রন্থটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের সম্পাদনায় (R. C. Majumdar) The History of Bengal Volume-1, Hindu Period) নামে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয়। রমেশচন্দ্র মজুমদার আশা করেছিলেন গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ব্যক্তিগত আগ্রহে ও দায়বোধ থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাচীন যুগপর্বের বাংলাদেশের ইতিহাস লেখায় আত্মনিয়োগ করেন।