প্রাথমিক অংশ

বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর উঠছে ওই। সেঁদা স্যাঁতা মেঘলা সকালের ম্যাদাটে আলোয় ও যেন বাড়ি নয়, বাড়ির ভৃত। চারদিকে বড় বড় দাঁতের মতো ইটের সারি যেন খিচিয়ে আছে। গায়ে ভারা বাঁধা। দেড় মানুষ সমান দেয়াল খাড়া হতে বছর ঘুরে গেল। এখন দেয়ালে শ্যাওলা ধরেছে, ভারার বাঁশ পচতে চলল। গেল মঙ্গলবার গো-গাড়িতে সিমেন্টের বস্তা এসেছে অনেকগুলো। পাটের নিচে সেগুলো ডাঁই হয়ে আছে। ছাদ কি আর ঢালাই হবে? বিষ্ণুপদ যে গতকাল রাতে কালঘড়ি দেখেছে। ও একবার দেখলে আর কথা নেই। দরিয়া পেরোনোর সময় ঘনিয়ে এল। কালঘড়ির কথা এরা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই বলেওনি কাউকে বিষ্ণুপদ। কথাটা বুকে নিয়ে, কৌটোর মুখ আট করে বন্ধ রেখে বসে আছে। আর কৌটোর মধ্যে প্রাণভোমরা চক্কর মারছে বো-বো করতে করতে। বেরোনোর পথ খুঁজছে। একটা র পেলেই পগার পার। আজ এই মেঘলা সকালে, হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটায় দাওয়ায় বসে বাদামতলার দিকে কাহিল চোখে চেয়ে আছে বিষ্ণুপদ। পারলি না তো বাপ, পেরে তো উঠলি না। তোর ঘর রোজ আমাকে মুখ ভ্যাংচায়, থাকবি বুড়ো? আয়, থাক এসে। রামজীবনের দোষ কি? জোগাড়-যন্তর কি চাট্টিখানি কথা! এটা জোটে তো সেটা জোটে না, দুশো এল তো চারশো বেরিয়ে গেল। নাকের জলে চোখের জলে হয়ে রামজীবন তবু বাপ আর মাকে পাকা ঘরে রাখবে বলে জান বড় কম চুঁইয়ে দেয়নি। তা তার ভাগ্যটাও এমনি। এবার সব জোগাড় হল তো অলক্ষুণে বর্ষা কেমন চেপে ধরল দুনিয়াটাকে। ডাইনীর এলো চুলের মতো ঝেঁপে থাকে মেঘ। সারাদিন একদিন একটু রোদ ওঠে তো হঠাৎ ফের ভূষোকালি মাখানেমেঘ থমথম করে ওঠে দিগন্তে। তারপর হাওয়া দেয়। রণপায়ে চলে আসে বৃষ্টি। টিনের চালে দিনরাত নাচুনে শব্দ। ঘরময় বাট, কৌটো, ভেঁড়া বস্তা পাতা। চালের পুরনো টিন চালুনির মতো হয়ে এল। কটা ফুটোর জল সামাল দেওয়া যায় বাপ! নিত্যনতুন ফুটো দিয়ে জল পড়ছে ঘরে। পাকাঘর এই হল বলে, আশায় আশায় এবার আর ঘরের টিন মেরামত হয়নি। হেমেন মিস্ত্রি কয়েক জায়গায় পুটিং ঠেসে দিয়েছিল শুধু। বর্ষার তোড়ে সে সব পুটিং কবে ভেসে গেছে।